আজকের শীর্ষ সংবাদ

সন্তানের জন্মের আগে মায়ের রক্তের গ্রুপ এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা জানা জরুরী কেন?

সন্তানের জন্মের আগে মায়ের রক্তের গ্রুপ এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা জানা জরুরী কেন?
Spread the love

মাতৃত্ব একটি রোগ নয়, কিন্তু একটি মহিলার জীবনের একটি স্বাভাবিক পর্যায়। কিন্তু এই স্বাভাবিক পর্যায়ে কখনো কখনো এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যাতে একজন মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি হতে পারে। চিকিৎসা উন্নয়নের এই দিনেও গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত জটিলতায় পৃথিবীর বুক থেকে কত তাজা প্রাণ ঝরে যায় বিজয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া সুলতানার মতো!

কি হলো

পত্রিকার খবরে বলা হয়, রাজিয়াকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসকের ভাষ্যমতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারি পরিভাষায়, প্রসবের পর এই রক্তপাতকে বলা হয় পোস্টপার্টাম হেমোরেজ (PPH)। এটি সন্তান জন্মদানকারী মায়ের একটি জটিলতা। জানা গেছে, রাজিয়ার ডেলিভারি বাড়িতেই হয়েছে। রাজিয়ার জীবন 21 বছর বয়সে শেষ হয়ে যেত না যদি তাকে কোনও মেডিকেল সেন্টারে বা বাড়িতে ডেলিভারি করানো যেত এবং তারপরে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেত। শুধু তাই নয়, রাজিয়া গর্ভাবস্থায় কোনো ধরনের অ্যান্টি-নেটাল চেকআপ বা প্রেগন্যান্সি চেকআপ নেননি বলে পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে। শুধু একবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিলেন টিকা নিতে। কখনও ডাক্তারের কাছে যাননি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই পরিস্থিতি সত্যিই হতাশাজনক। মাতৃমৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্যের গর্ব করে। কিন্তু খবর সেই গর্বকে ভেস্তে দেয়।
সন্তান জন্মজনিত জটিলতায় পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলেন সফল ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা।
সন্তান জন্ম সংক্রান্ত জটিলতায় পৃথিবীর বুক থেকে উধাও হয়ে গেলেন সফল ফুটবলার রাজিয়া সুলতানাছবি: সংগৃহীত

কী বলছেন চিকিৎসকরা?

অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স বিভাগের সাবেক প্রধান ডা: সালমা রউফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একজন গর্ভবতী নারী যেকোনো সময় যেকোনো অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন হতে পারেন। কিন্তু প্রসবের সময় সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যান। প্রসবের পরও সে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়। প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ বাংলাদেশ এবং সমগ্র বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ। প্রসবের পর প্রথম 24 ঘন্টার মধ্যে রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। বিশেষ করে প্রথম ছয়-আট ঘণ্টা খুবই বিপজ্জনক। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রসবের পরও প্রসব-পরবর্তী জটিলতার কারণে মায়ের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

কে প্রসব পরবর্তী জটিলতার ঝুঁকিতে আছে আর কে নয় তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। প্রফেসর সালমা রউফ বলেন, প্রায় 85 শতাংশ মা যারা অতিরিক্ত প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ অনুভব করেন তাদের পূর্বে বিদ্যমান কোনো জটিলতা নেই। প্রত্যেক মায়ের প্রসবের পর কিছু রক্তপাত হয়, যা স্বাভাবিক। কিন্তু একজন মা এবং তার পরিবারের পক্ষে বোঝা কঠিন যে কতটা রক্তপাত স্বাভাবিক বা কোন শারীরিক লক্ষণ অতিরিক্ত রক্তপাতের ইঙ্গিত দেয়। অতএব, তিনি জোর দিয়েছিলেন যে প্রতিটি প্রসব একটি মেডিকেল সেন্টারে হওয়া উচিত, বাড়িতে নয়।

কি করা যেত?

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে বাড়িতে কিছু করার নেই। জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য হাসপাতালের প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। অত্যধিক রক্তপাতের ক্ষেত্রে, রক্ত ​​সঞ্চালনও জরুরিভাবে প্রয়োজন। অর্থাৎ তখন রক্তদাতার খোঁজ নেওয়া হয়। তাই আগে থেকেই মায়ের রক্তের গ্রুপ জেনে নিতে হবে। জরুরি সময়ে ছুটে আসতে পারেন এমন অন্তত দুজন রক্তদাতার ব্যবস্থা করা দরকার। মনে রাখবেন, একজন মায়ের প্রসবের পর ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত অতিরিক্ত রক্তপাতের ঝুঁকি থাকে।

অধ্যাপক সালমা রউফ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বলেন। যদি মায়ের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা এমনিতেই কম থাকে, তাহলে মাঝারি রক্তক্ষরণও মায়ের শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মায়ের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আগে থেকেই জানা উচিত। প্রসবের আগে মায়ের রক্তের গ্রুপ এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা জেনে রাখা এবং অন্যান্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত এবং এর জন্য প্রসবপূর্ব যত্ন প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুসারে, গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের শারীরিক পরীক্ষার জন্য অন্তত চারবার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়া উচিত। মায়ের কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না, কতটা জটিল, অনাগত সন্তানের কোনো সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না—সবই এই সময়ে জানা যায়। এছাড়াও, গর্ভধারণের আগে একজন মহিলার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত যে তিনি গর্ভাবস্থার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে উপযুক্ত কিনা। একজন মহিলার এত কিছু সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত, পরিবারকেও জানা উচিত। গর্ভাবস্থা উপেক্ষা করা খুব সাধারণ।

আমরা কতদূর এসেছি?

গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি লাখে ১৫৬ জন নারী সন্তান প্রসবের সময় জটিলতার কারণে মারা যায় (বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২২)। আর এর দুই-তৃতীয়াংশ হয় প্রসবোত্তর বা প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের কারণে। পিপিএইচ বা প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের প্রথম ঘন্টাকে বলা হয় গোল্ডেন আওয়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে পৌঁছায় অনেক দেরিতে। রাজিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু যে মেয়ে সমাজের তোয়াক্কা না করে একদিন ফুটবল খেলতে মাঠে নেমে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিল, তার অবহেলায় মৃত্যু কি মেনে নেওয়া যায়? তাহলে আমরা কতদূর এগিয়েছি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *