আজকের শীর্ষ সংবাদ

বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।

বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।
Spread the love

মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি… কবিতার এই পঙক্তির মতো মাঠে মাঠে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌমাছির দল। দিগন্তজোড়া মাঠে হলুদের সমারোহ। যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। সরিষার হলুদ ফুলে শীতের সোনারাঙা রোদের ঝিকিমিকি মৌমাছিকে হাতছানি দেয়। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে ছুটে যায়। অন্যদিকে হলুদ-সবুজের মিতালি মাখা সরিষা ক্ষেত, কৃষকের চোখে-মুখে নতুন স্বপ্নের রং ছড়িয়ে দেয়। সারাদেশে এ বছর সরিষার বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে রাঙা হাসি।

বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।
বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।


এবছর সারাদেশে সরিষার আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং ফলন বেশ ভাল হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৬ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এবছর আট লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদন সাড়ে ৯ লাখ টন ছাড়াতে পারে বলেও মন্ত্রণালয় আশা করছে। গত বছর সারাদেশে ৬ লাখ ১০৬ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছিল। উৎপাদন ছিলো ৮ লাখ ২৪ হাজার টন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সয়াবিন তেলের মূল্য নিয়ে চলছে তেলেসমাতি। এ জন্য কৃষক এবার সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছে। দেশের বিভিন্ন সরিষা আবাদ অনেক বেশি হয়েছে ফলনও ভাল হয়েছে।


দেশে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। আমদানিতে এগিয়ে সয়াবিন ও পাম অয়েল। এতে বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সরিষার উৎপাদন বাড়িয়ে এ ব্যয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। এ বছর উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় মনে করছে।
দেশে উৎপাদিত তেলের মধ্যে সরিষা শীর্ষে। এছাড়া সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ দু’-একটি অপ্রচলিত তেলবীজের চাষ হয় সামান্য। দেশের ভোজ্যতেলের প্রায় ৬০ ভাগ আসে সরিষার তেল থেকে এবং এটিই আমাদের ভোজ্যতেলের প্রধান ফসল। বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৩৮ থেকে ৪৪ শতাংশ তেল থাকে আর বাকিটা খৈল। এই খৈলে ২৫ শতাংশ থেকে ও ৪০শতাংশ আমিষ। এই খৈল গৃহপালিত পশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে প্রতি হেক্টরে সরিষার ফলন হয় ৬০০ থেকে ৭২৫ কেজি। আমন ও বোরো চাষের মাঝের সময়ে বড় অংশ জমি পতিত থাকে। এ পতিত জমি ব্যবহারসহ দেশে তেলবীজের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা অর্ধেকে আনতে ৩ বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করছে সরকার। রোডম্যাপ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশ কিছু তেলজাতীয় ফসলের সঙ্গে সরিষার আবাদ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। আর তাতে সুফলও মিলতে শুরু করেছে। এ বছর সারাদেশে ব্যাপকভাবে বেড়েছে সরিষার চাষাবাদ।


বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতার কারণে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারও গত বছর থেকে বেশি অস্থিতিশীল। ভোক্তারা তেল কিনেছেন রেকর্ড দামে। সেটার একটি প্রভাব পড়েছে সরিষা চাষে। গত এক বছরের তুলনায় সরিষা বীজের দাম প্রতি মণে বেড়েছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সে কারণেও চাষিরা সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন।
সয়াবিন ও পাম তেলের দাম দ্রæত বাড়ায় দেশে সরিষার তেলের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য সচেতন অনেক মানুষ এখন সরিষার তেল বেছে নিচ্ছেন।


খিলগাঁও রেলগেইট বাজারে দীর্ঘদিন ধরে তেলের ব্যবসা করছেন গাজী ওয়েল মিলসের স্বত্বাধিকারী আমির হোসেন। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, আগে তো সয়াবিন ছিল না। তখন শুধু সরিষার তেল খেয়েছে মানুষ। আমার মিলে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ সরিষা ভাঙাতে হতো। হঠাৎ করে সরিষার আবাদ কমে যাওয়ায় এবং কিছু সস্তায় সয়াবিন তেল পাওয়া যাওয়ায় মানুষ সরিষার তেল খাওয়া কমিয়ে দিয়ে ছিল। এখন সয়াবিনের দাম যে ভাবে বাড়ছে তাতে আবারও মানুষ সরিষার তেলের প্রতি ঝুঁকছে। যদি সরিষার উৎপাদন বাড়ানো যায় তাহলে আগের মতো মানুষ আবার সরিষার তেলই খাবে।

বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।
বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।


সরিষা চাষে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাতের সরিষা চাষ করে ফলন যেমন বেশি হচ্ছে তেমনি দামও ভাল পাচ্ছে কৃষক। বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি, সরিষার ভালো দাম পাওয়া, উন্নত জাতের কারণে স্বল্পসময়ে অধিক ফলন, কম খরচ ও অল্প পরিশ্রমে ফসল পাওয়ায় এখন সরিষা চাষে দেশের কৃষক বেশ আগ্রহী হচ্ছে।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার হিরণপুরের কৃষক সোলেমান বলেন, উচ্চ ফলনশীল বিনা জাতের সরিষার ফলন গত বছর বেশ ভাল হয়েছিল। বিঘা প্রতি সাত মণেরও বেশি হয়েছে। সে সময় বাজারে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা মণ দরে সরিষা বিক্রি করেছেন। এতে বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এ বছর আরো দুই বিঘা বেশি জমিতে তিনি আবাদ করেছে। মোট সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে সরিষার ফলনও বেশ ভাল হয়েছে।


ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ টনের চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করে। আমদানির মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল প্রায় পাঁচ লাখ টন। সয়াবিন বীজ আমদানি হয় প্রায় ২৪ লাখ টন, যা থেকে চার লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। আর ১১ লাখ টন অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, আগে সব মিলিয়ে স্থানীয়ভাবে ভোজ্যতেলের উৎপাদন দুই থেকে আড়াই লাখ টন ছিল। এর মধ্যে সরিষা, সূর্যমুখীসহ অন্য ভোজ্যতেল রয়েছে। তবে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে গত বছর শুধুমাত্র সরিষার তেলই ৮ লাখ টন ছাড়িয়েছে। এ উৎপাদন ১০ থেকে ১২ লাখ টন করা সম্ভব। আর তা হলে বছরে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা আমদানি ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে সরকার ৩ বছরের রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছে। সে অনুযায়ী ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসল আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে সরিষার তেল উৎপাদনের পরিকল্পনা সাড়ে ২৬ লাখ টন।

বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।
বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।


এ প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে দেশের ২৫০ উপেজলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২২২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। গত বছর তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে ৫শ’ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে সরকার।
তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নেওয়া প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিন বলেন, পাঁচটি তেলজাতীয় ফসল সরিষা, সূর্যমুখী, সয়াবিন, চিনাবাদাম ও তিলের উৎপাদন বাড়াতে কাজ চলছে। এ বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা, ৭০ হাজার বিঘা জমিতে সূর্যমুখী, ২৬ হাজার বিঘা জমিতে চিনাবাদাম এবং ২৪ হাজার বিঘা জমিতে সয়াবিন চাষে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।


শুধু প্রকল্প নয়, উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও (বিনা) কাজ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ও বোরো চাষ হয়। দুই ধান চাষের মাঝখানের মৌসুমে প্রায় দুই মাস ২০ লাখ হেক্টর জমি পতিত থেকে যায়। সেগুলোতে সরিষা ও অন্য তেলজাতীয় বিভিন্ন ফসলে আগ্রহী করতে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বিনা। এ বছর এ দুই ফসলের মধ্যে প্রচুর এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে সরিষা চাষ হয়েছে।


দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন হলুদ রঙের সরিষা ফুলের সমারোহ। সরিষা আবাদের পাশেই মৌ চাষের প্রচলনও বেড়েছে। মাঠের পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন। ফলে সরিষাচাষি ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হওয়ায় সরিষা চাষে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান ইনকিলাবকে বলেন, পুষ্টিচাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে দেশে তেল উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট, ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেটের কারণে যে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার তাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে নিজের উৎপাদিত তেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে।

বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।
বাড়ি সরিষার বাম্পার ফলন।

দিনাজপুরে এবার সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠে এখন হলুদের ঢেউ। সরিষার এই ফলনে কৃষকের চোখেমুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠেছে।  

জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়- ফসলের মাঠগুলো সরিষা ফুলের হলুদ রঙে অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। মাঠে পরিচর্চার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দিনাজপুরে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। গতবার ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছিল।

হাকিমপুর উপজেলার জালালপুর গ্রামের সরিষা চাষি আকরাম হোসেন বলেন, দেশে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েই চলছে, তাই তেলের চাহিদা মেটাতে আমি সরিষার চাষ করছি। প্রতি বছর বাড়ির জন্য ১৫ শতক সরিষা চাষ করতাম। কিন্তু মানুষের চাহিদা পূরন করতে আরও ১৫ শতক বেশি সরিষার চাষ করেছি।

ঘোড়াঘাট উপজেলার ডুগডুগি গ্রামের আয়জার রহমান বলেন, প্রতি বছর আমি এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করি। এ বছর দুই বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছি। তেলের চাহিদা মেটাতে আমি বেশি করে সরিষার চাষ করছি।

হাকিমপুর উপজেলা কৃষি অফিসার ড. মমতাজ সুলতানা বলেন, চলতি আমন মৌসুমে উপজেলায় ১৪০০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করেছে কৃষকেরা। গত বছর এই উপজেলায় সরিষার চাষ হয়েছিলো ৮৩০ হেক্টর জমিতে। আমরা মোট ৯৬০ জন কৃষককে বিনামূল্যে সরিষার বীজ ও সার প্রদান করেছি।

দিনাজপুর কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক প্রদীপ কুমার গুহো বলেন, এ বছর জেলায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ করেছেন কৃষকেরা। ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিকটন সরিষার ফলন হবে বলে আশা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *