আজকের শীর্ষ সংবাদ

দেশী খেজুর চাষ পদ্ধতি

দেশী খেজুর চাষ পদ্ধতি
Spread the love

দেশি খেজুর গাছ (ফিনিক্স সিলভেস্ট্রিস) বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রস ও ফল সংগ্রহের আবহমান পদ্ধতি। যাহা ব্যবহার করা হয় রস সংগ্রহ, ফল সংগ্রহ, ঘরের চাহনী ও জ¦ালানি কাঠ হিসেবে। গাছের রস দিয়ে উন্নত মানের সিরাপ তৈরি করা হয়। তাই ইহা একটি পুরাতন গাছ ফসল (ফায়াদুল এবং আল শোইমান, 1990)।

বাংলাদেশে সাধারণত দেশি খেজুর সব জেলাতে উৎপন্ন হয়। তবে দেশের যশোর ফরিদপুর, নাটোর, মাগুরা, খুলনা ও চরাঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে উৎপন্ন হয়। ইহার স্ত্রী গাছ ও পুরুষ গাছ আলাদা হয়। স্ত্রী গাছ ও পুরুষ গাছ হতে রস আহরণ করা হয় এবং স্ত্রী গাছ হতে ফলও উৎপন্ন হয়।

ইদানীং দেশের কিছু প্রগতিশীল চাষি আরবীয় খেজুরের চাষ করে যাহা এখনও আমাদের দেশে পরীক্ষাধীন অবস্থায় আছে। আরবীয় খেজুর গাছ হতে শুধুমাত্র আরবীয় খেজুর ফল সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত স্ত্রী গাছের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা প্রায় স্ত্রী গাছ হয় এবং ফল ধরে। এক্ষেত্রে স্ত্রী গাছের বাগানে পুরুষ গাছও থাকতে হয় যাতে পরাগায়ন হতে পারে। তাই স্ত্রী গাছের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে এর বিস্তার ব্যাপক হারে ঘটানো সম্ভব।

দেশি খেজুরের চারা উৎপাদন ও রোপণ পদ্ধতি

সাধারণত দেশি খেজুরের বীজ বীজতলায় বপন করে তৈরি করা যায়। বীজতলার মাটি বেলে মিশ্রিত ভিটা মাটি হলে ভালো হয়। তাহলে চারা গজাতে সুবিধা হয়। তবে পলিব্যাগে ও চারা উৎপাদন করা যায়। ভালো গুণাগণ সম্পন্ন মাটি দিয়ে পলিব্যাগ তৈরি করে খেজুরের বীজ উলম্বভাবে ১.৫ সেমি.-২ সেমি. পলিব্যাগের ভেতরে বপন করলে ১.৫- ২ মাসের মধ্যে বীজ হতে চারা গজানো হয়। তবে অঙ্কুরোদগম হার বৃদ্ধি করার জন্য বীজকে খালি পাত্রে ২ দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং এই ২ দিনে প্রতিদিন ১বার করে বীজগুলোকে পানিতে নেড়ে চেড়ে পুরাতন পানি ফেলে দিয়ে নতুন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।

তার পর বীজগুলোকে পলিব্যাগে বা বীজতলায় বসিয়ে দিতে হবে। অঙ্কুরিত চারার বয়স যখন ১ বছর হবে তখন চারা রোপণের উপযোগী হবে। সাধারণত জুন জুলাই হতে আগস্ট সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। চারা রোপণের জন্য মূল জমিতে র্২ ঢ র্২ ঢ র্২ গর্ত ১০ ফুট ঢ ১০ ফুট দূরে দূরে করতে হবে। প্রতিটি গর্ত ৩-৪ ইঞ্চি গভীর হতে হবে।

প্রতিটি গর্তে ১০ কেজি গোবর ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ সার মিশ্রিত করে গর্তের মাটি গোবর ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে গর্তটিকে ঢেকে দিতে হবে। এতে মিশ্রিত সার ও গোবর পচন ক্রিয়া সম্পন্ন হবে। প্রায় ১৫-২০ দিন পর উপরের মাটি সরিয়ে পলিব্যাগ থেকে চারা মাটিসহ আলগা করে গর্তে বসিয়ে দিয়ে গাছের গোড়ায় পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে পলিব্যাগের মাটি ভালোভাবে ভিজে যায় এবং গর্তের মাটির সাথে মিশে যায়।

সার প্রয়োগ

উংপাদনক্ষম খেজুর গাছের গোড়া থেকে ৭৫ সেমি. দূরে গোলাকৃতি করে ১০-১৫ সেমি. গভীর গর্ত খুড়ে প্রতি বছর অক্টোবর ও মে মাসে প্রতি বারে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি ও ২০ কেজি পচা গোবর সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। দেশি খেজুর গাছে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। তবে মাঝে মাঝে কোন কোন গাছে বিটলজাতীয় পোকা দেখা যায়।

স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ

গাছ সাধারণত নির্বাচন করা হয় ৫-৭ বছর বয়সের। যে সকল গাছ দেখতে সুস্থ সবল, সেসব গাছ নির্বাচন করলে অধিক রস আহরিত হয়। খেজুর গাছের রস সংগ্রহের জন্য গাছ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খেজুরের রস সংগ্রহ গাছ কাটার ওপর নির্ভর করে কারণ রস সংগ্রহের জন্য প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ করা অতীব জরুরি। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ গাছি দিয়ে গাছ কাটলে ও রস আহরণের হার ও গাছের স্থায়িত্ব উভয়ই বৃদ্ধি পাবে।

খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য কিভাবে গাছ কাটতে হবে গাছের কোন অংশে কতটুকু কাটতে হবে, কোন সময়ে বেশি পরিমাণ রস, সর্বোপরি গাছটি কিভাবে কাটলে অধিক রস সংগৃহীত হবে এবং গাছটি দীর্ঘস্থায়ী হবে তাহা গাছীর সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এই সব ধারণা ও জ্ঞান থাকলে গাছটি সহজে মরবে না। আর এই জন্য গাছীকে অবশ্যই প্রশিক্ষিত হতে হবে।

কারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ এবং তাহা থেকে সিরাপ, গুড়, পিঠা, পায়েস ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরি করার জন্য অধিক পরিমাণে রস আহরণ করতে পারবে। গবেষণায় দেখা গেছে গাছের বেডের অংশ লম্বা ও ৭.৫-১০ সেমি. গাছ কাটলে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায়।

রস সংগ্রহ পদ্ধতি

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি অর্থাৎ কার্তিক মাসের প্রথম দিকে গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করতে হয়। গাছ পরিষ্কার করার পর ১৫-২০ দিন পর গাছ কাটা শুরু করতে হয়। এরপর ছাটা অংশের যেখানে রস নিঃসরণ শুরু করা হয় সেখানে ট আকৃতির চিকন প্রায় ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা বাশের কঞ্চি আধা ইঞ্চি পরিমাণ গাছে ঢুকিয়ে দিতে হয়। ট আকৃতির কাঠির মধ্যে দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গাছের রস ঝুলন্ত হাঁড়িতে জমতে থাকে।

গাছ একবার ছাটলে ৩-৪ দিন রস সংগ্রহ করা হয় এবং পরবর্তীতে ৩ দিন শুকাতে হয়। এইভাবে কাটলে গাছের রস সুমিষ্ট হয়। রস সাধরণত নভেম্বর- ডিসেম্বর হতে মার্চ মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করতে হয়। রস সংগ্রহের পর হাঁড়ি পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকাতে হয় অথবা আগুনে ছেকে নিতে হয়। এতে সংগৃহীত রসে গাঁজন (Fermentation)) বন্ধ হয়।

রস সংগ্রহের জন্য ধারালো দা, মাটির পাত্র বা হাঁড়ি, নেট বা জাল লোহার বা স্টিলের কড়াই, চুলা, জ¦ালানি, ছাকনি, কাঁচের বোতল ও বোতলের কর্ক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

ফলাফল

২০১৯-২০ ক্রপ মৌসুমে আঞ্চলিক সুগারক্রপ গবেষণা কেন্দ্র, গাজীপুরে একটি খেজুর বাগানে বর্ণিত পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত রস দিয়ে সিরাপ, পায়েস ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাধারণত খেজুর গাছের সংগৃহিত রসের বিক্স ৮-১২% পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে এবং সিরাপের বিক্স ৭০-৭৮% পর্যন্ত পাওয়া যায়। বর্ণিত মৌসুমে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি ও মার্চ মাসে রস সংগৃহীত হয়। উক্ত মাসগুলোর ৬টি দিনের রসের হাঁড়ির রস মাপা হয়।

ফলাফলে দেখা যায় যে গাছ কাটার প্রথম দিকে রসের পরিমাণ কম; পরবর্তী মাসে গাছের রসের পরিমাণ বাড়তে থাকে অর্থাৎ জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি মাসে রসের পরিমাণ বেশি সংগৃহীত হয়েছে। ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে রসের পরিমাণ কমতে থাকে যাহা তাপমাত্রার সাথে সম্পর্কিত।

খেজুর রসের সিরাপ উৎপাদন

গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে ছাঁকনি দিয়ে ছেকে সংগৃহীত রস কড়াইতে বা পাতিলে ঢেলে চুলায় জ¦াল দিতে হয়। রস জ¦াল দেয়ার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে গাদ বা ফেনা ভেসে উঠে। উক্ত গাদ বা ফেনা যত দ্রæত সম্ভব ছাঁকনি দিয়ে ফেলে দিতে হবে। ফলে গুণগত মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত গুড় হবে। রস ঘনীভূত হলে দেখা যাবে রস আঠালো হয়েছে কি না।

ঘনীভূত রস আঠালো সিরাপের মতো হলে রস চুলা থেকে নামিয়ে সিরাপ তৈরি করতে হবে এবং উক্ত সিরাপের ঘনত্ব (বিক্স %) ৭০-৭৮ হলে ভালো হয়। ফলে উক্ত সিরাপ তৈরি করলে সিরাপ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং গুণগত মানসম্পন্ন হয়।

দেশী খেজুর চাষ পদ্ধতি
দেশী খেজুর চাষ পদ্ধতি

খেজুরের গুড় প্রস্তুতকরণ

খেজুরের সিরাপ কড়াইয়ের মধ্যে রেখে জ্বাল দিতে হবে। ফুটন্ত ঘনীভূত রস হাতলের সাহায্যে লাগাতার নাড়তে হবে এবং চুলার তাপমাত্রা দ্রæত কমিয়ে আনতে হবে। চুলা থেকে গুড় নামানোর সময় মিশ্রিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে গুড় অর্থাৎ এক চিমটি পরিমাণ গুড় ২০০ মিলি লিটার পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। পানিতে গুড় দ্রæত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে এবং চুলা থেকে গুড়সহ কড়াই দ্রæত নামিয়ে ঠাÐা করতে হবে এবং ছাঁচে ঢালতে হবে।

খেজুর গাছের ফল উৎপাদন

সাধারণত জুলাই আগস্ট মাসে দেশীখেজুর স্ত্রী গাছের ফল সংগৃহীত হয়। খেজুরের ঝারের ফল যখন গাড়ো হলুদ বর্ণ হয় তখন পাকা শুরু করে। পাকা ফল যখন শালিক পাখি খেতে দেখা যায় তখন উক্ত খেজুরের ঝার কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ১-২ দিনের মধ্যে সমস্ত খেজুর পেকে যায়। তখন পাকা ফল সংগ্রহ করে খাওয়ার উপযোগী হয় বা বাজারজাত করা হয়।

অধিক খেজুর গাছ লাগানোর জন্য আমাদের কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নতি সাধন সম্ভব হবে। সিরাপ, পাটালী গুড় ও খেজুরের ফল উৎপাদন কুটির শিল্প হিসাবে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *