সালাফদের মধ্যে অনেকে মনে করতেন, পুরো কুরআনের ভাবার্থ নিহিত আছে সূরা ফাতিহার মধ্যে। আর পুরো সূরা ফাতিহার ভাবার্থ নিহিত আছে এই আয়াতটির মধ্যে। কারণ, এই আয়াতটির প্রথম অংশে তাওহিদের সমর্থন এবং শিরকের প্রতি নিজের অনাস্থা ঘোষিত হয়- ‘আমি কেবল আপনারই ইবাদত করি।’ দ্বিতীয় অংশে ঘোষিত হয় নিজের ক্ষমতার প্রতি অনাস্থা এবং আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতার স্বীকৃতি-‘কেবল আপনার কাছেই সাহায্য চাই।’
এই আয়াতে আল্লাহর সাথে বান্দার একটি নিবিড় সম্পর্কের চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে। দয়াময় আল্লাহকে সরাসরি বলা হচ্ছে-‘আল্লাহ! আমি আর কাউকে রব হিসেবে মানি না, কারও নিকট মাথা নত করি না, কারও বশ্যতা স্বীকার করি না, কারও ইবাদত করি না। কেবল আপনাকেই রব হিসেবে মানি, তাই কেবল আপনারই ইবাদত করি, আপনার নিকটই চাই; অন্য কারও কাছে চাই না। আপনি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে আমি আর কাছে কাছে যাব? আমার যে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই!’ রাসূল সর্বদা সাহাবিদের বলতেন-
‘যখনই কিছু চাইবে আল্লাহর কাছে চাও, সাহায্যের হাত পাতলে আল্লাহর দরবারেই পাতো।’
রবের সাথে বান্দার এই সম্পর্ক এই কথারই সাক্ষ্য দেয়-আমি আমার সমস্ত ব্যক্তিসত্তাকে, আমার অস্তিত্বকে, আমার সমস্ত স্বাধীনতাকে, সমস্ত ইচ্ছা-পছন্দ ও খায়েশকে মহান আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়েছি। তাঁর একত্ববাদের সাক্ষ্য দিচ্ছি। আমি মনে করছি, কেবল তিনিই দিতে পারেন এবং ইবাদত পাওয়ার যোগ্য কেবল তিনিই। আল্লাহ এই স্বীকৃতিটাই আমাদের কাছে চান। এই স্বীকৃতির জন্যই এই সূরার এত মহত্ত্ব।
আল্লাহর সাথে বান্দার এই নিবিড় সম্পর্ক বর্ণনার পর আমরা পরের আয়াত থেকে নিজেদের প্রার্থনা ও দাবি-দাওয়া পেশ শুরু করি। বলি-
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
‘আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করো।’
এখানে ‘সিরাতল মুসতাকিম’-এর অনুবাদ আমরা করেছি ‘সরল-সঠিক পথ’, কিন্তু ‘সিরাতল মুসতাকিম’ বা মুসতাকিমের পথ বলতে কী বোঝানো হয়েছে- তা নিয়ে মুফাসসিরে কেরামগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
জাবির বলেন-
‘সিরাতল মুসতাকিমের অর্থ হলো ইসলাম, যা আকাশ-পৃথিবী ও এর মাঝে যা কিছু আছে-সবকিছুর চেয়ে প্রশস্ত!’
অর্থাৎ ইসলামি শরিয়াহ যে পদ্ধতিতে মানুষের জীবন পরিচালনা করতে বলে, সেটাই সিরাতল মুসতাকিমের পথ। আল্লাহ তায়ালা নিজেই সিরাতল মুসতাকিমের চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন-যা রাসূল বর্ণনা করেছেন।
‘সিরাতল মুসতাকিম এমন একটি পথ, যার দুই দিকে দুটি প্রাচীর রয়েছে। সেই প্রাচীরের মাঝে কয়েকটি খোলা দরজা আছে। প্রতিটি দরজার ওপরই পর্দা টাঙানো আছে। সিরাতল মুসতাকিমের প্রবেশদ্বারে সার্বক্ষণিকের জন্য একজন আহ্বানকারী নিযুক্ত করা আছে। সে সর্বদা আহ্বান করে বলছে-“হে মানবসকল! তোমরা এই সোজা পথ ধরে চলো; আঁকাবাঁকা পথে যেয়ো না।” আবার অন্য পথগুলোর ওপরেও পাহারাদার আছে। কেউ সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে তারা সতর্ক করে বলে-“সাবধান! এটা খোলো না। যদি খোলো, তবে মূল পথ থেকে ছিটকে পড়বে।” সিরাতল মুসতাকিম হলো ইসলাম, আর প্রাচীরগুলো হলো আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়। প্রবেশদ্বারে আহ্বানকারী হচ্ছে কুরআন এবং রাস্তার ওপর আহ্বানকারী হলো তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়-যা প্রত্যেক বান্দার অন্তরে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
ইবনে জারির (রহ.) আরেকটু সহজ করে বলেন-
‘যে পথে চললে আল্লাহ তাঁর বান্দার ওপর সন্তুষ্ট হন এবং পুরস্কৃত করেন, সেটাই সিরাতল মুসতাকিমের পথ।’
আল্লাহ তায়ালা নিজেও সূরা ইয়াসিনে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট করে বলেছেন-
وَأَنِ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ –
‘এবং আমারই দাসত্ব করো-এটিই সরল-সঠিক পথ।’ (সূরা ইয়াসিন: ৬১)