আজকের শীর্ষ সংবাদ

আনারস চাষ পদ্ধতি

আনারস চাষ পদ্ধতি
Spread the love

আমকে যদি ফলের রাজা বলা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে আনারস ফলের রানী।

কেননা মাথায় মুকুট পরে কাঁটার আসনে বসে গাম্ভীর্যের সাথে আনারস গর্বিতভাবে জীবন যাপন করে। তাছাড়া ছানাবড়া চোখ শুধু আমাদেরকেই ধাঁধায় না, চোখ তুলে খেতেও বেশি কষ্ট করতে হয়। চেহারা, রূপ-লাবণ্য সব মিলিয়ে আনারসই ফলের রানী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। কাব্যরসিকরা অবশ্য আনারসকে স্বর্ণকুমারী বলেন। তাইতো ছন্দাকারে বলা যায়… আনারস মধুর ফল পুষ্টিগুণে ভরা, অর্থ দেয় লাভ দেয় দূর করে জরা। গবেষকদের ধারণা আনারসের উৎপত্তিস্থল ব্রাজিলে।

আনারস উৎপাদনে লিডিং দেশগুলোর মধ্যে আছে কোস্টারিকা, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইন্ডিয়া।
আনুমানিক ১৫৪৮ সালের দিকে আমাদের এ অঞ্চলে আনরস এসেছে। পাকা আনারসের অম্ল মধুর রসালো মিষ্টি গন্ধ হৃদয় ছুঁয়ে যায়, খাওয়ার প্রতি লোভ বাড়িয়ে দেয়। আনারস অবশ্যই দারুণ মনোহরি সুগন্ধি, উপাদেয় এবং সুস্বাদু ফল। আনারসের জুস, স্লাইস, এসিড, স্কোয়াশ, সিরাপ, জ্যাম, জেলি, আনারসসত্ত্ব, ভিনেগার, সাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম সাইট্রেট, অ্যালকোহল বিশ্বনন্দিত।

কুশকুশে কাশি জ্বরে আনারস মহৌষধ। তাছাড়া আনারসের পাতা থেকে মোম ও সুতা তৈরি হয়। টিনে সংরক্ষণ করার পরও আনারসে কিছু পরিমাণ ভিটামিন থাকে। পাকা আনারসে গড়ে শতকরা ১০ ভাগ চিনি ১ ভাগ সাইট্রিক এসিড থাকে। টাটকা আনারসের মধ্যে প্রোটিন জাতীয় খাদ্যে পরিপাক ও হজমের সহায়ক ব্রোমিলিন নামক জারকরস থাকে। বাণিজ্যিক ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে আনারস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

দেশের অধিকাংশ বাড়িতে ২-৪টি আনারস গাছ আছে। কিন্তু আবহাওয়া মাটি যতœ এসবের অভাবে সেসবে আনারস ফলে ঠিকই কিন্তু তেমন আশাবাদ ফলন দেয় না। আনারস বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং টাঙ্গাইল জেলায় ব্যাপকভাবে চাষ হয়। ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, দিনাজপুর জেলাতেও আনারসের চাষাবাদ হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর এলাকার আনারস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশে আনারস সাধারণত তাজা পাকাফল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে উৎপাদিত আনারসের বেশিরভাগই প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে।
আনারসের বোটানি

আনারসের কা- বেশ ছোট, বহু সংখ্যক অতিঘন সন্নিবিষ্ট পুরু ও লম্বা পাতা দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে। মূল ছোট। ১ ফুটের মতো মাটির গভীরে যায়। পাতা পুরু ও পিচ্ছিল বলে কিছু পরিমাণ অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি সহ্য করতে পারে। এত গুণে গুণান্বিত এবং উপকারী ফল বছরের ৫-৬ মাস দেখাই যায় না। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে ওই সময় তারা মাতৃজঠরে আবদ্ধ থাকে।

আবার যখন পাকা শুরু হয় তখন এক সাথে পাকে। আবার চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সেপ্টেম্বর-মে মাসে ওষুধ সেবনের জন্যও পাওয়া যায় না। বর্তমানে দেশে ৫০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আনারসের চাষ হচ্ছে। শুধু নানিয়াচর উপজেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমিতে আানরস হয়। উৎপাদনও পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের ওপরে। আমাদের দেশে সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলের চাষ করা হয়।

আনারস একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফল। আনারসের বৈজ্ঞানিক নাম ব্রোমেলিয়াডে এনারা কামসুস পরিবারভুক্ত।

বাংলাদেশের অনেক স্থানেই আনারস চাষ করা হয়। ২০১৪ সালের হিসাব মতে, বিশ্বে সাড়ে ২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন আনারস উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে কোস্টারিকায় পৃথিবীর ১১% আনারস উৎপাদিত হয়।

পুষ্টি ও ভেষজ গুণ

পাকা ফল বলকারক, কফপিত্ত বর্ধক, পাচক ও ঘর্মকারক। কাঁচাফল গর্ভপাতকারী। পাকা ফলের সদ্য রসে ব্রোমিলিন নামক জারক রস থাকে যা পরিপাক ক্রিয়ার সহায়ক এবং রস পাণ্ডুরোগে হিতকর। কচি ফলের শাঁস ও পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে সেবন করলে ক্রিমির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

পুষ্টিমানের বিচারে আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ বি সি পাওয়া যায়। তাছাড়া ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস আছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। জ্বরে বিশেষ পথ্য ও ওষুধ হিসেবে কাজ করে।

আনারসের জাত

আনারসের বেশ কয়েকটি জাত আছে। এর মধ্যে হানিকুইন একটি। হানিকুইন ডলডুপি হিসেবেও পরিচিত। চোখ সূচালো ও উন্নত। গড় ওজন প্রায় ১ কেজি। পাতা কাঁটাযুক্ত ও পাটল বর্ণের। হানিকুইন বেশ মিষ্টি আনারস।

মধুর মতোই মিষ্টি। পাকা আনারসের শাঁস হলুদ রঙের। চোখ সূচালো ও উন্নত। সবচেয়ে বড় আকারের জাত হচ্ছে জায়ান্টকিউ। নামের সাথে মিল রেখেই এর আকারও বড় আকৃতির। পাকা অবস্থায়ও আনারস সবুজাভ শাঁস হালকা হলুদ।

চোখ প্রশস্ত ও চেপ্টা। গাছের পাতা সবুজ ও প্রায় কাটাবিহীন। গড় ওজন ২ কেজি। ক্যালেন্ডুলা আরেকটি জাত। মাঝারি আকারের ভালোই মিষ্টি। ওজন ১ থেকে দেড় কেজি। আরও একটি উল্লেখযোগ্য জাত হচ্ছে ঘোড়াশাল।

পাকা আনারস লালচে এবং ঘিয়ে সাদা হয়। চোখ প্রশস্ত। পাতা কাঁটা বিশিষ্ট, চওড়া ও ঢেউ খেলানো থাকে। গড় ওজন ১ থেকে ১.২৫ কেজি। বেশ মিষ্টি। এগুলো ছাড়া দেশীয় হয়তো আরও জাত থাকতে পারে যেগুলো বাড়ির আঙিনার আশপাশে জন্মে।

বংশবিস্তার

স্বাভাবিক অবস্থায় আনারসের বীজ হয় না। তাই বিভিন্ন ধরনের চারার মাধ্যমে আনারসের বংশবিস্তার হয়। সাধারণত পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা দিয়ে আনারসের বংশবিস্তার হয়। এর মধ্যে পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।

আনারসের বিভিন্ন জায়গা থেকে চারা উৎপন্ন হয়। সব ধরনের চারাই ব্যবহার করা যায় চাষের জন্য। পাতার কক্ষ থেকে, মাটির কাছের পাতার কক্ষ থেকে, ফলে বোঁটার পাশ থেকে, মাথার মুকুট বা পুরনো গাছের গোড়া থেকে চারা পাওয়া যায়। তবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেন, পাতার কক্ষ থেকে পাওয়া চারা বেশি ভালো।

আনারস গাছে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপন্ন হয়। পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা, গোড়ার চারা বা ট্যাম্প। সব ধরনের চারাই রোপণ করা যায়, তবে পার্শ্ব চারা ও গোড়ার চারাই উত্তম।

জমি ও মাটি

উঁচু জমি ও পানি দাঁড়ায় না দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি আনারস চাষের জন্য বেশ উপযোগী। মাটি ঝুরঝুরে করে মই দিয়ে জমি সমতল করতে হয় যাতে বৃষ্টির পানি কোনো স্থানে জমে না থাকতে পারে। জমি থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু এবং ১ মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে। এক বেড থেকে অন্য বেডের মধ্যে ৫০-১০০ সেন্টিমিটার ফাঁক রাখতে হবে। পাহাড়ের ঢাল আনারস আবাদে বেশ উপযোগী।

পাহাড়ের ঢালে আনারসের চাষ করার জন্য কোনোক্রমেই জমি চাষ দিয়ে বা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করা উচিত নয়। এতে ভূমিক্ষয়ের মাধ্যমে উর্বর মাটি ধুয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শুধু পাহাড়ের জঙ্গল বা আগাছা মাটির স্তরে কেটে পরিষ্কার করে জমি চারা রোপণের উপযোগী করে তুলতে হবে।

চারা রোপণ ও সার ব্যবস্থাপনা

গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে আনারস চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈবসার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে।

বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশী যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচাসার ব্যবহার করা যায়। বাড়ির আশপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা স্তূপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।

মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ অর্থাৎ অক্টোবর নভেম্বর মাস আনারসের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাছাড়া সেচের সুবিধা থাকলে মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসেও চারা লাগানো যায়। এক মিটার প্রশস্ত বেডে দুই সারিতে চারা রোপণ করতে হবে।

৫০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে লাইনে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে চারা লাগাতে হবে। চারা বেশি লম্বা হলে ৩০ সেন্টিমিটার পরিমাণ রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে আনারস চাষের জন্য কন্টুর পদ্ধতি বা সমউচ্চতা বরাবর ঢালের বিপরীতে আড়াআড়িভাবে জোড়া সারি করে চারা রোপণ করা হয়। কখনও ঢাল বরাবর সারিতে চারা রোপণ করা উচিত নয়।

এতে ভূমিক্ষয় বাড়ে। পাহাড়ের ঢালে জোড়া সারিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার ও চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার দেয়া উচিত। এতে হেক্টরপ্রতি ৫০ হাজার বা কানিপ্রতি (৪০ শতাংশ) ৮ হাজার চারা প্রয়োজন। নির্ধারিত স্থানে চারা রোপণের পর গোড়া ভালোভাবে চেপে দেয়া উচিত। যদিও পাহাড়ি এলাকাতে দূরত্ব সঠিকভাবে মানেন না।

আনারস চাষ পদ্ধতি
আনারস চাষ পদ্ধতি

সার ব্যবস্থাপনা

গাছপ্রতি পচা গোবর ৩০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৩৫ গ্রাম, টিএসপি ১৫ গ্রাম, এমওপি ৩৫ গ্রাম ও জিপসাম ১৫ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে যত চারা আছে তা হিসাব করে সে মতো সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর, জিপসাম ও টিএসপি সার বেড তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার চারা রোপণের ৪-৫ দিন পর থেকে শুরু করে ৫-৬ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

সার বেডে ছিটিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে আনারস একটি উল্লেখযোগ্য ফসল। সেখানে পাহাড়ের ঢালে কন্টুর পদ্ধতিতে সুন্দর লাইন করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আনারস লাগানো হয়।

সার ব্যবস্থাপনাও সমতল ভূমির আনারসে চেয়ে ভিন্নতর। চারা রোপণের দুই মাস পর গাছপ্রতি ইউরিয়া ও টিএসপি সার ১০ গ্রাম করে গাছের গোড়া থেকে ১৫ সেন্টিমিটার দূরে ডিবলিং পদ্ধতিতে/পেগিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে। একইভাবে গাছের বয়স যখন ৭-৮ মাস হবে তখন আর একবার একই মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হয়।

সেচ ও নিকাশ

শুকনো মৌসুমে আনারস ক্ষেতে সেচ দেয়া খুবই প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেজন্য নালা কেটে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। চারা বেশি লম্বা হলে ৩০ সেন্টিমিটার পরিমাণ রেখে আগার পাতা সমান করে কেটে দিতে হবে। আগাছা আনারসের খুবই ক্ষতি করে। তাই আনারসের জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখা প্রয়োজন। বছরে অন্তত দুইবার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে; একবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল সংগ্রহ করার পর ও দ্বিতীয় বার অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।

গাছ বড় হওয়ার আগে এটি সম্ভব। কিন্তু গাছ ঝোপালো হয়ে গেলে আগাছা পরিষ্কার করা যায় না তেমনি পরিষ্কার করার তেমন প্রয়োজনও পড়ে না। জমিতে সেচ এবং সার প্রয়োগের পর মালচিং করে নিলে জমি আগাছামুক্ত থাকে। আগাছা দিয়ে মালচিং করার পর একসময় পচে জৈবসার হিসেবে মাটিতে যুক্ত হয় এবং এতে করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।

বালাই ব্যবস্থাপনা

আনারসে সাধারণত বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। চাষের জমিতে পোকার আক্রমণ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করলে বেশি ভালো হয়। তবে যে কোনো প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।

আনারসে হরমোন ট্রিটমেন্ট

বাংলাদেশে যে পরিমাণ আনারস উৎপাদিত হয় তার অধিকাংশই আসে মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য ভাদ্র অর্থাৎ জুন থেকে আগস্ট মাসে। এ সময় আম, কলা, পেয়ারা, কাঁঠাল এসব ফলেরও মৌসুম। কাজেই এ সময় আনারসের দাম কমে যায়। এমনকি এক সাথে প্রচুর আনারস পাকার ফলে এবং বৃষ্টির দিনে পরিবহনের অভাবে আনারস পচে যায়, নষ্ট হয়।

বছরের অন্যান্য সময়ে এর চাহিদা বেশি থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন না থাকায় তা খাওয়া যায় না। তাছাড়া আনারসভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হলেও সারা বছর এর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। পরিকল্পিতভাবে হরমোন প্রয়োগ করে সারা বছর কাক্সিক্ষত সময়ে আনারস পাকানো যায়।

আনারস উৎপাদনে প্রধান সমস্যার মধ্যে রয়েছে গাছে ফুল আসতে ১৫-১৬ মাস এবং আনারস পাকতে ২১-২২ মাস সময় লেগে যায়। এতে ফলের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা জমিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বিশ্বে আনারস উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশে বহুকাল আগে থেকেই হরমোন প্রয়োগ করে আনারসের উৎপাদন করা হচ্ছে। হরমোন প্রয়োগে সুবিধা হলো- কম সময়ে আনারস পাওয়া; একসাথে বা কাক্সিক্ষত সময়ে আনারস পাওয়া; ইচ্ছে অনুযায়ী যে কোনো সময়ে আনারস পাকানো যায়; অমৌসুমে আনারস বিক্রি করে বেশি দাম পাওয়া যায়; কম খরচে বেশি লাভ করা যায়- হরমোন প্রয়োগে আনারসপ্রতি খরচ মাত্র ২০ পয়সা থেকে ২৫ পয়সা আর আনারস প্রতি বাড়তি লাভ ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা; সারা বছর ফলানো যাবে বলে উৎপাদনের এবং সরবরাহের বছরব্যাপী নিশ্চয়তা পাওয়া যায়;

বর্ষা মৌসুমে পরিবহন,

স্তূপিকীকরণ সমস্যাজনিত অপচয় হবে না; বাগানে অতিরিক্ত উৎপাদন সম্ভব হবে কেননা, হরমোন প্রয়োগে ৮০-৯০% গাছে ফল ধারণ করে হরমোন ব্যতিরেকে গড়ে ৫০-৬০% গাছে ফল ধরে।

আনারসের ক্ষেত্রে ০১. ইথ্রেল ০২. ক্লোরোইথাইল ফসফোনিক এসিড ০৩. ন্যাপথলিন এসিটিক এসিড, ফুল আনতে সাহায্য করে। তবে বাংলাদেশে অমৌসুমে আনারসে ফুল আনার জন্য ০১ নং ও ০২ নং হরমোন বেশি কার্যকর। ক. ইথ্রেল ৫০০ পিপিএম দ্রবণ তৈরির জন্য প্রতি লিটার পরিষ্কার পানিতে ১.৩ মিলিলিটার তরল ইথ্রেল (৩৯% ইথাফন) মিশিয়ে নিতে হবে। খ. ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পরিষ্কার পানিতে ১০ গ্রাম দানাদার ক্যালসিয়াম কার্বাইড প্রথমে অল্প পানিতে মিশিয়ে তৈরি দ্রবণ পরবর্তীতে পুরো পানির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

হরমোন দ্রবণ প্রতিদিন ভোরবেলায় সকাল ৬-৮টায় ৯ থেকে ১৩ মাস বয়সের ৩০-৪০ পাতাবিশিষ্ট প্রতি গাছে ৫০ মিলিলিটার হরমোন দ্রবণ গাছের ডগায় ঢেলে দিতে হবে। হিসাব করে দেখা গেছে, ১ লিটার হরমোন দ্রবণ দিয়ে ২০টি গাছে প্রয়োগ করা যায়।

বৃষ্টি বাদলার দিনে হরমোন প্রয়োগ করলে কার্যকারিতা কম হয়। প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন বৃষ্টি না হয় এ চিন্তা মাথায় রেখে দ্রবণ প্রয়োগ করতে হবে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিডিউল করে হরমোন প্রয়োগ করলে কাক্সিক্ষত এবং অমৌসুমে আনারস পাওয়া যায়। এ হরমোন মানুষের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। প্রতি মাসেই ১ একটি ব্লকে আনারস চারা রোপণ করতে হয় বা একবার রোপণ করে ৩-৪টি ব্লকে ভাগ করে ক্রমান্বয়ে প্রতি মাসে হরমোন প্রয়োগ করলে কাক্সিক্ষত সময়ে আনারস পাকার ব্যবস্থা করা যায়।

অমৌসুমে আনারস উৎপাদন করে চাষি যেমন লাভবান হতে পারেন তেমনি ক্রেতারাও বিশেষ স্বাদ নিতে পারেন। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে হরমোন প্রয়োগ করলে ১০ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হরমোন প্রয়োগ করলে মোটামুটি ৪০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। আর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হরমোন প্রয়োগ করলে ৪০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফুল আসে। এ পদ্ধতিতে মোটামুটিভাবে শতকরা ৮০ থেকে ১০০ ভাগ গাছে ফল আসে।
মুড়ি ও সাথী ফসল চাষ

আনারস চাষে অন্যান্য লাভের সাথে আরেকটি লাভ মুড়ি ফসল। মুড়িগাছ একাধিক বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং ফল ধরে। সাধারণত মুড়ি ফসল থেকে ৫ থেকে ৬ বছর সফলভাবে ফল সংগ্রহ করা যায়।

ঘোড়াশাল জাতের বেলায় কাপাসিয়া এলাকায় ৪০ থেকে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুড়ি ফসল থেকে ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে আগাছা পরিষ্কার, শূন্যস্থান পূরণ, সার প্রয়োগ, বালাই ব্যবস্থাপনার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।

আনারসের সাথে অনায়াসে আদা, সয়াবিন, সরিষা, কলাই, কচু সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন ফল গাছের বাগানের ভেতর আনারস আবাদ করে। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত ট্যারেসিং বা কন্টুর পদ্ধতিতে ৬০ সেন্টিমিটার গভীর ও ৩০ সেন্টিমিটার প্রস্থ চাষ করা ভালো। পাহাড়ি এলাকায় জমি তৈরিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেন না বেশি নাড়াচাড়া করলে ভূমি ক্ষয় হয়ে যাবে।

ফল সংগ্রহ খরচ ফলন ও লাভ

সাধারণত চারা রোপণের ১৫-১৬ মাস পর মাঘ মাসের মাঝামাঝি থেকে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে আনারস গাছে ফুল আসে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে আগস্ট মাসে আনারস পাকে।

পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে। কিছু কিছু জাত আছে সারা বছর আনারস দেয়। প্রতি হেক্টরে ঘোড়াশাল ১৫ থেকে ২০ মেট্রিক টন, হানিকুইন আনারস ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিক টন এবং জায়ান্টকিউ ৩০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আনারস চাষের জন্য প্রায় ২০,০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। সে মতে, হেক্টরপ্রতি দেড় থেকে ২ লাখ টাকা খরচ হয়। আর হেক্টরপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা লাভ হয়। আনারস বহুগুণে গুণান্বিত ফল।

আমাদের আছে অবারিত উপযোগী জমি ভূমি। একটু বেশি দরদ দিয়ে আবাদ আর প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে আনারস দিয়ে আমরা বিশ্ব মাতাতে পারব। শুধু প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা, কার্যক্রর ব্যবস্থাপনা আর বাস্তবায়ন কৌশল। শুধু পাহাড়ের আনারস দিয়েও আমরা নতুন সম্ভাবনাকে আরও বেগবান করতে পারব অনায়াসে।

তথ্যসূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *