ব্রিটিশরা আসার পূর্বে বাংলা শাসন করত মুসলিমরা। সে সময় বাংলা ভূখণ্ড ব্যাপক সমৃদ্ধশালী ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উর্বর ভূমি ছিল আমাদের। ফসলের পাশাপাশি সিল্ক, তুলা, তাঁত ও বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। ঢাকাকে ম্যানচেস্টারের মতো শিল্পসমৃদ্ধ শহরের সাথে তুলনা করা হতো। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর অবস্থা প্রায় রাতারাতি বদলে যায়। ইংরেজরা ব্যাপক আকারে আমাদের শোষণ করা শুরু করে। কয়েক বছরের মাথাতেই ১৭৭০ সালে সংঘটিত হয় ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষ। ইতিহাসে যা ছিয়াত্তরের মনন্তর নামে পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। কেউ বলেন, এই সংখ্যা কোটির কাছাকাছি। এর ফলে বাংলার সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুছে যায়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর হবার পর বাংলাতে জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয়। এদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু এবং কলকাতাকেন্দ্রিক। তারা আমাদের পূর্ববঙ্গের মুসলিমদেরকে ব্যাপকভাবে শোষণ করা শুরু করে। দাড়ি রাখা, আযান দেওয়া, গরু জবাই করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দরিদ্র, নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও তাদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহায় পায় না।
ইংরেজরা আমাদের তাঁত ও বস্ত্র শিল্প ধ্বংস করে দেয়। আমাদের বিখ্যাত শাড়ি মসলিন হারিয়ে যায়। তাঁতিদের আংগুল পর্যন্ত কেটে নিত ওরা, যেন তাঁত বুনতে না পারে। আমাদের কৃষকদের জন্য ধান চাষ করা ছিল লাভজনক। কিন্তু সে সময় ইউরোপে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়। এর জন্য দরকার পড়ে নীলের। ইংরেজরা আমাদের চাষীদের বাধ্য করে নীল চাষ করতে। নীলকরেরা চাষীদের সাথে খুবই নিষ্ঠুর আচরণ করত। হিন্দু-মুসলিম দেখত না। নীলচাষীদের অত্যাচার অনুসন্ধানের জন্য ১৮৬০ সালে গঠিত হয় নীলকর কমিশন। তারা প্রতিবেদনে বলে, ইংল্যান্ডে যে নীলের বাক্সগুলো যায় সেই বাক্সগুলোর প্রত্যেকটিমানুষের রক্তে রঞ্জিত।
আসলে সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে পূর্ব বাংলার ঘরে ঘরে ছিল কেবল হাহাকার আর কান্না। মজলুমের আর্তনাদে আকাশ- বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠত। ইংরেজরা বেনিয়া জাত। আমরা ছিলাম সবচেয়ে ধনী অঞ্চল। কাজেই আমাদের ওপর ইংরেজ ও অত্যাচারী জমিদারদের নজর বেশি ছিল। শোষণ আর জুলুমের এক লজ্জাজনক ইতিহাস রচনা করে তারা। পূর্ব বাংলায় নেমে আসে এক গভীর অন্ধকার। ক্ষুধা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, রোগব্যধি, জুলুম, বঞ্চনা নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় আমাদের পূর্বপুরুষদের।
এমনই এক ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে পূর্ববাংলা তথা ভারতবর্ষের সকল ধর্মের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষদের জন্য আলো জ্বেলে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ফরায়েজীরা। তাঁরাই ভারতবর্ষে প্রথম সংঘবদ্ধ আন্দোলন শুরু করেছিলেন ইংরেজ আর তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে। এ তথ্য শুনে গর্ব হচ্ছে না তোমার? আমি যখন প্রথম জেনেছিলাম আমার খুব গর্ব হয়েছিল। আমাদেরকে ভেতো বাঙ্গালী হিসেবে অনেকেই অবজ্ঞা করে। অথচ আমরাই প্রথম ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম! ফরায়েজী আন্দোলনের রূপকার হাজী শরীয়তউল্লাহকে নিয়ে আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছিলাম।[১] আজ আমরা আলোচনা করব ফরায়েজী আন্দোলনের আরেক বিখ্যাত নেতা, হাজী শরীয়তউল্লাহ রহিমাহুল্লাহর যোগ্যপুত্র মুহসিন উদ্দীন দুদু মিয়াকে নিয়ে।
১৮১৯ সাল। মাদারিপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্ম হয় তাঁর। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর পিতার কাছ থেকে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁকে মক্কায় পাঠানো হয় জ্ঞানার্জনেরজন্য। ছোট থেকেই তাঁর অন্তরে তাওহীদ, শিরক এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো গেঁথে যায়। পিতার শিক্ষা এবং সংগ্রামী জীবন দেখতে দেখতে তিনিই পিতার মৃত্যুর পর ফরায়জী আন্দোলনের কর্ণধার হয়ে উঠেন।
ঐতিহাসিক সূত্রমতে, কলকাতা হয়ে মক্কা গমনকালে বারাসাতে তাঁর সাথে বাংলার আরেক মহান বীর তিতুমীরেরাখ দেখা হয়। তিনি মক্কায় পাঁচ বছর গভীর অধ্যয়ন করেন। ১৮৩৭ সালে দুদু মিয়া মক্কা থেকে বাড়ি ফিরে আসেন।
১৮৪০ সালে পিতা হাজী শরীয়তউল্লাহর ইন্তেকালের পর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন দুদু মিয়া। তাঁর অধীনে বাংলা ও আসামের নিপীড়িত জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় ব্রিটিশদের বশংবদ অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
দুদু মিয়া অসাধারণ সাংগঠনিক গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ফরায়েজীদের সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার ফলাফল ছিল বিস্ময় জাগানিয়া।
ইংরেজ ঐতিহাসিক ডা. জেমস ওয়াইজ বিস্মিত হয়ে ফরায়েজী আন্দোলন নিয়ে রচিত তার বইতে লিখেন-
‘মাত্র কয়েকজন লোক এই আন্দোলন শুরু করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা এক বিশাল ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এই বৃক্ষ এখন পুরো পূর্ববঙ্গে তার ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে। এই আন্দোলনে জমিদার ও ধনী শ্রেণির সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল না। সরকারেরও কোনো পৃষ্ঠপোষকতা বা সমর্থন ছিল না। তা সত্ত্বেওকীভাবে এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবী শ্রেণির প্রায় সকলেই এটাকে গ্রহণ করে নেয়?’
সেই সময়কার বেঙ্গল পুলিশের এক কমিশনারের মতে ফরায়েজীদের মোট সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৮০ হাজার। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বেঙ্গল হরকরা পত্রিকার সম্পাদক অ্যালেক্স্যান্ডার ফোর্বসের মতে সংখ্যাটা ছিল ৩ লাখ।
চলো, দুদু মিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও কৌশল সম্পর্কে জেনে নিই।
লাঠিয়াল বাহিনী গঠন: দুদু মিয়া ফরায়েজী আন্দোলনকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার জন্য বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। কেউ কোথাও অত্যাচারিত হচ্ছে শুনলে তিনি লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে দিতেন। কোনো অত্যাচারিত হিন্দু দুদু মিয়ার কাছে সাহায্য চাইলে তিনি কখনো তাদের ফিরিয়ে দিতেন না। বরং তাদের বিশেষভাবে সাহায্য করতেন।
লাঠিয়াল বাহিনীর ভয়ে ইংরেজ সৈনিক ও জমিদার এবং নীলকরেরা থরথর করে কাঁপত। দুই দশক অর্থাৎ ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ফরায়েজী আন্দোলন অধ্যুষিত এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। সাধারণ জনগণ সকল ধরনের জুলুম ও শোষণের হাত থেকে রেহায় পায়। মুসলিমরা নিশ্চিন্তে আযান দেওয়া, দাড়ি রাখা, গরু জবাই করতে পারতেন।
স্থানীয় আদালত প্রতিষ্ঠা: ইংরেজ ও অত্যাচারী জমিদার নীলকরেরা আদালতের মাধ্যমে জুলুম করত। দুদু মিয়া এজন্য নিজস্ব বিচারব্যবস্থা তৈরি করেন। স্থানীয় মুরব্বিদের দিয়ে আদালত (তথা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠা করেন ও ইংরেজদের আদালত বয়কট করতে বলেন। সব ধরনের বিবাদের মীমাংসা করা হতো এই আদালতগুলোতে। ন্যায়বিচার পাওয়ায় অল্পদিনেই ফরায়েজীদের আদালত ব্যাপক
জনপ্রিয়তা পায়। জানা যায়, আমাদের ঢাকাতেই২২ টির বেশি ফরায়েজী আদালত ছিল।
হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্মের নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য করা: অনেক উগ্র ব্যক্তি দাবি করে, দুদু মিয়া উগ্র ছিলেন, সাম্প্রদায়িক ছিলেন। অথচ তিনি হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্মের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।
বাংলার পুলিশ সুপার ড্যাম্প্যাইয়ার ড. ওয়াইজ মন্তব্য করেন, ‘ফরায়েজীরা জাতভেদ দূর করে ইসলামের আলোকে মানুষে মানুষে সমতা ও ভাতৃত্ববোধ তৈরি করেন। নীচু জাতের মানুষদের বিষয়াবলি উঁচু জাতের মানুষের বিষয়াবলির মতোই সমান গুরুত্ব দেওয়া হতো। ফরায়েজীরা পরস্পর একতাবদ্ধ থাকা ও বিপদাপদে সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন।
জেমস ওয়াইস, উইলিয়াম হান্টারসহ অন্যান্য ইতিহাসবেত্তাগণ বলেছেন, ‘সব ধর্মের জালিমরাই ফরায়েজীদের শত্রুতে পরিণত হয়। হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে যে উদ্দীপনা নিয়ে তারা লড়াই করেছেন সেই একই উদ্দীপনা নিয়ে তারা অত্যাচারী মুসলিম জমিদার ও ইংরেজ নীলচাষীদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতেন।’
খলীফা নিয়োগ ও ঐক্যবদ্ধ থাকা: দুদু মিয়া নিজেদের মধ্যে মারামারি হানাহানি অনৈক্য পছন্দ করতেন না। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দেন। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য তিনি প্রত্যেক এলাকায় খলীফা নিয়োগ দেন। খলীফারা ছিল তাঁর প্রতিনিধি স্বরূপ। তাঁদের কাজ ছিল স্থানীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, মুষ্ঠি সংগ্রহ করা, স্থানীয় কোর্ট পরিচালনা করা, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা। ইংরেজ প্রশাসনের সমান্তরালে দুদু মিয়া নিজেই যেন একটা প্রশাসন বা ছায়া সরকার পরিচালনা করতেন।নবীনচন্দ্র সেন, সেই সসময়কার এক সাব- ডিভিশন অফিসার বলেছিলেন- ‘ফরায়েজীর। ব্রিটিশ রাজের পাশাপাশি নিজেদের এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে।’
খলীফা নিয়োগের ফলে বিভক্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, তথ্য আদান-প্রদান, মুষ্ঠি তথা চাঁদা সংগ্রহ ও কূটনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগ সহজ হয়। বিশাল অঞ্চলজুড়ে সমন্বিত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
ইংরেজ ও তাদের এজেন্টদের ওপর অর্থনৈতিক বয়কট: হাজী শরীয়তউল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন
জমিদার এবং ইংরেজদের কোনো ধরনের কর না দিতে। আমাদের দুদু মিয়া পিতার পথ ধরেই ঘোষণা করলেন- জমি যে চাষ করবে ফসলের মালিক হবে সে-ই। ইসলামে বলা হয়েছে, ফসলের জন্য শুধু উশর দিতে হবে। এ ব্যতীত কোনো কর যেন কাউকে দেওয়া না হয়। ইংরেজরা কূটকৌশলের মাধ্যমে মাসজিদ, মাদরাসা ও খানকার অনেক ওয়াকফকৃত জমি দখল করে নিয়েছিল। দুদু মিয়া খাস জমি ও বন এলাকা দখল করতে শুরু করেন। খাস এলাকায় দরিদ্রদের থাকার ব্যবস্থা করেন।
১৮৫৭ সালে যখন গোটা ভারতে মহাবিদ্রোহের ডামাডোল চলছিল, ঠিক তখনই জমিদার ও নীলকররা দুদু মিয়া ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কান ভারী করে তোলে।
১৮৪৬ সালে এনড্রিও এন্ডারসনের গোমস্তা কালি প্রসাদ মনিবের আদেশে সাত আটশ লোক নিয়ে দুদু মিয়ার বাড়িতে চড়াও হয় এবং প্রায় দেড় লক্ষ টাকা মূল্যের অলংকারাদিসহ বহু ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় বিচার চেয়ে তিনি মামলা করেন। কিন্তু কোনো বিচার না পাওয়ায় অবশেষে নিজেই শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে ডানলপের কারখানা আক্রমণ করেন। আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন সেই কারখানা। তাঁর এইসাফল্যে জমিদার ও নীলকররা শংকিত হয়ে পড়ে। তারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একের পর এক মামলায় দুদু মিয়া ও তাঁর অনুসারীদের ফাঁসাতে শুরু করে। অবশেষে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের আবহাওয়া তৈরি হলে বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে পারে এই অজুহাতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় তিনি যদি জেলের বাইরে থাকতেন তাহলে এই বাংলা তথা উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। তাঁর অনুপস্থিতির কারণে ফরায়েজীদের বিপুল শক্তি ভালোমতো কাজে লাগানো যায়নি সে সময়।
দুদু মিয়া ১৮৫৯ সালে মুক্তি পেলেও অসৎ জমিদারদের উসকানিতে আবারও বন্দি হন। কোনো মামলা না থাকা সত্ত্বেও ১৮৬০ সাল পর্যন্ত তাঁকে কলকাতার অদূরে আলীপুরে বন্দি রাখা হয়। যখন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন তাঁর স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায়। মুক্তির অল্পকাল পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এর পর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এখানেই ইন্তেকাল করেন তিনি। পুরান ঢাকার ১৩৭ নং বংশাল রোডে কবর দেওয়া হয় তাঁকে। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কুফর এবং শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা এই সিংহপুরুষ।
দুদু মিয়া বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের মতো গতানুগতিক রাজনীতি করেননি। ইসলামী মূল্যবোধ ও জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর স্পৃহা থেকে তাঁর পিতা যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি তাতে রাজনৈতিক রং দেন। তবে এই রং মানুষের বানানো কোনো তন্ত্রমন্ত্রের ছিল না। বরং এই রঙের উৎস ছিল ইসলামী শরীয়াহ।
তিনি সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি। কিন্তু কৌশলে ঠিকই ইংরেজদের উচ্ছেদের জন্য কাজ করেছেন। ইংরেজ ও জমিদারদের কর প্রদান বন্ধ, খাসমহল দখল,অসহযোগিতার নীতি অনুসরণ, লাঠিয়াল বাহিনী গঠণ, স্থানীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ছায়া সরকার পরিচালনা, জনগণকে হানাহানি, মারামারি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনে উৎসাহিত করা, কূটনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগ করা ইত্যাদি ছিল ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সমতুল্য। ইংরেজরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল তা।
বাংলার পুলিশ সুপার ড্যাম্প্যাইয়ার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ অন্যান্যরা বলেছিল, ‘পূর্ব বাংলায় হাজী শরীয়তউল্লাহর হাতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুস্তান থেকে ইংরেজদেরকে বের করে পুনরায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা ও বহাল রাখা।’
সাধারণ মানুষ প্রাণভরে তাঁকে ভালোবাসত। তিনি ছিলেন বাংলার অঘোষিত বাদশাহ। ১৮৪৭ সালে কলকাতা রিভিউ দুদু মিয়াকে বাদশাহর সাথে তুলনা করে। নীল কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়- ‘দুদু মিয়াকে দমন করার প্রচেষ্টা ব্যাপক রক্তপাতের সূচনা করবে।’
একবার ফরিদপুর কোর্টে দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলো। তিনি নাকি কোনো এক নীলকর হত্যাচেষ্টার সাথে যুক্ত। রায়ের দিন কোর্টের পাশের নদীতে প্রায় ৩০০০ নৌকা এসে হাজির। ৩০০০ নৌকাভর্তি ফরায়েজী অপেক্ষা করছে। আদালত দুদু মিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিলে কোর্ট ভেঙ্গে তাঁকে মুক্ত করা হবে।
ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গ্রন্থের লেখক সুপ্রকাশ রায় বলেন, ‘দুদু মিয়ার নেতৃত্বে অন্তত পঞ্চাশ হাজার হিন্দু-মুসলমান কৃষক যেকোনো সময় জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে লাঠি হাতে লইয়া সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িতে ইতস্তত করিত না।’
বাংলার এই অঘোষিত বাদশাহকে নিয়ে আজকাল তেমন আলোচনা হয় না। সব জায়গা থেকে তাঁকে মুছে ফেলা হয়েছে, হচ্ছে। তবেচাইলেই কি তাঁর মতো মহামানবকে মুছে ফেলা যায়? তিনি থাকবেন বাংলার প্রতিটি কিশোর- কিশোরী, তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতীর হৃদয়ে। যারা এ জমিনকে, এ জমিনের মানুষগুলোকে প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। যারা অশ্লীলতা, অনাচার, অনৈতিকতা, অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা, বিভেদ, হানাহানিতে ভরে যাওয়া এই সমাজকে বদলে দিয়ে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে চায়। যারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। তিনি থাকবেন প্রত্যেক ন্যায়ের পথের পথিকের আলোর দিশারী হয়ে।
সালাম জানাই আপনাকে, হে মহান বীর! ভোরের শিশিরের মতো রহমত ঝরে পড়ুক আপনার কবরে।